বাংলা সংবাদপত্র প্রসঙ্গে আলোচনা করলে কুমারখালীর নাম ওঠে সর্বাগ্রে। কেননা সংবাদ পত্র প্রকাশের জন্য কুমারখালী ইতিহাসের একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। আর এর মূলে রয়েছেন সাহিত্যের সাংবাদিক শ্রী হরিনাথ মজুমদার ওরফে কাঙাল হরিনাথ। বাংলাদেশে বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশনার জগতে তিনি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনকারীর দাবিদার। যদিও ইতিহাস তাঁর থেকে অনেকটাই মুখ ফিরিয়েছে। দীর্ঘদিন রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে চরম অনাদর আর অবহেলায় পড়ে থাকা কুন্ডুপাড়াস্থ কাঙালহরিণাথের বাস্তভিটায় সরকারী উদ্যোগে কাঙাল স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়েছে।
বাংলার গৌরব, সাংবাদিক ও স্বভাব কবি কাঙালহরিনাথ সম্পর্কে জানা যায় ১৮৩৩ সালের ২২ জুলাই গড়াই তীরবর্তী কুমারখালীতে তিনি জন্ম গ্রহন করেন। বাল্যকালেই পিতা হলধর মজুমদার এবং মাতা কমলীনী দেবি। পিতা-মাতা হারিয়ে শৈশবেই তাঁকে জীবন সংগ্রামের চিন্তায় বিব্রত থাকতে হয়েছে। কাঙালহরিনাথ পরিনত বয়সে নিঃশ্ব- নিরক্ষর গ্রামবাসিদের অভাব-অভিযোগ, দুঃখ-দুর্দশা দূর করার মানসে এবং তৎকালীন আমলাদের বর্বর-লোমহর্ষক নির্যাতন উৎপীড়ন তৃনমূল থেকে উৎপাটনের হাতে লিখে দ্বি-মাসিক পত্রিকা প্রকাশনা শুরু করেন। পাশাপাশি কোলকাতার একটি ইংরেজি পত্রিকার সাংবাদিকতার সাথে সাহিত্য সাধনায় ব্রতী হন। বাংলা ১২৭০ সালে হরিনাথ মজুমদার তাঁর দ্বি-মাসিক পত্রিকা গ্রামবার্তা প্রকাশিকাকে কলকাতার গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন প্রেস থেকে মাসিক হিসেবে প্রথম প্রকাশ করে ইতিহাস গড়েন। প্রত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশের জন্য ব্যাপক আলোড়ন তোলে। পর্যায়ক্রমে তিনি গ্রামবার্তাকে পাক্ষিক ও সাপ্তাহিকে আত্মপ্রকাশ ঘটান। নিয়মিত ১০ বছর ‘গ্রামবার্তা’ কোলকাতা থেকে প্রকাশের পর ১২৮০ সালে স্থাপন করেন একটি প্রেস। প্রেসটির নামকরন করা হয় মথুরানাথ ছাপা খানা ( এম এন প্রেস) প্রেসটি স্থাপনের জন্য সর্বাগ্রে যিনি আর্থিক সহায়তা করেন ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়। কাঙালহরিনাথ মজুমদারের ‘গ্রামবার্তা’ পত্রিকার মাধ্যমে ইংরেজ শাসন, নীলকরদের নির্যাতন, জোতদার, মহাজন ও পুলিশের অত্যাচার নির্যাতনের বর্ণনা প্রকাশ করা হত। সে সময় হাজারো বাধা ‘গ্রামবার্তা’ কে রুখতে পারেনি, কারন একনিষ্ঠ সাংবাদিক কাঙালহরিনাথ তাঁর লিখনিতে কখনো মাথানত করেনি। ভয় কিংবা প্রলভনের কাছে বশ হয়নি তাঁর বৈশিষ্ট্য। তাইতো পাবনার তৎকালীন জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মিঃ থামফ্রে ফাঈম কাঙালহরিনাথকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘এডিটর তোমাকে ভয় করি না বটে, কিন্তু তোমার লিখনীর জন্য অনেক কুকর্ম পরিত্যাগে বাধ্য হয়েছি’ । এই চিঠির কথা গুলোই সাক্ষী দেয় গ্রামবার্তা সে সময় কোন চরিত্রে প্রকাশ পেত।
কাঙালহরিনাথ মজুমদার ‘গ্রামবার্তা’ প্রকাশের ক্ষেত্রে যে নির্ভিক কলম যোদ্ধার পরিচয় দিয়েছিলেন তা হয়েছিল মূলত সাহসী ও দূঢ় চরিত্রের জন্যই। তিনি ‘গ্রামবার্তা’ এম এন প্রেসকে কেন্দ্র করে কুমারখালীতে একটি সাহিত্য পরিমন্ডল গড়ে তোলেন। যা পরবর্তীতে অবিভক্ত বাংলায় এক বিরাট অবদান রাখে। গ্রামবার্তা প্রকাশিকায় তৎকালীন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের খ্যাতনামা পন্ডিতরা লিখতেন। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন বিষয়ক প্রবন্ধ, ছড়া ইত্যাদিও এতে প্রকাশিত হত। প্রখ্যাত মুসলিম লেখক মীর মশাররফ হোসেনের সাহিত্যচর্চার হাতেখড়িও হয় এ পত্রিকার মাধ্যমে। তিনি গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকার একজন মফঃস্বল সাংবাদিক ছিলেন। ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায় এ পত্রিকায় তার অনেক লেখা প্রকাশিত হয়। এ পত্রিকার মাধ্যমেই তিনি পরবর্তীকালে মুসলমান রচিত আধুনিক বাংলা সাহিত্যে সমন্বয়ধর্মী প্রবর্তক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। কাঙালহরিণাথ ছিলেন তাঁর সাহিত্যগুরু।‘বিষাধ সিন্ধু’র কালজয়ী ঔপন্যাসিক মীর মোশাররফ হোসেন ছিলেন কাঙালহরিনাথের অন্যতম শিষ্য। মীরের সম্পাদিত ‘আজিজন নেহার’ ও ‘হিতকারী’ পত্রিকা দু’টির অধিকাংশ সংখ্যাই এম এন প্রেস থেকে প্রকাশিত হত। এ ছাড়াও রাজবাড়ীর রওশন আলীর ‘কোহিনুর’ লোলিত মোহন পাল ও রাধা বিনোদ শাহার ‘শাহাজীর’ পত্রিকাও হরিনাথ মজুমদারের ঐতিহসিক এম এন প্রেস থেকে ছাপা হত। জানা যায়, বিষাদ সিন্ধু’র প্রখম কপি এ প্রেস থেকেই প্রকাশিত হয়। হিমালয় ভ্রমনকাহিনীখ্যাত লেখক ও সাংবাদিক জলধর সেনের সাহিত্যচর্চাও শুরু হয় এ পত্রিকার মাধ্যমে। দিনলিপি ডাইরিতে কাঙালহরিনাথ লিখেছেন আমিই লেথক, আমিই সম্পাদক, আমিই ছাপাকারী, আমিই বিক্রেতা এবং আমিই পত্রিকার প্রধান কর্তা। এই প্রেসের মাধ্যমে তিনি ১০/১২ জনের কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন।
তাছাড়াও পাঠ্য-পুস্তক, দেশী, বিদেশী পত্র-পত্রিকা বিক্রয় করার জন্য একটি পুস্তকালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যদিও সেটি বেশিদিন স্থায়িত্ব পায়নি। কাঙালহরিনাথ মজুমদার প্রায় অর্ধশত পুস্তক রচনা করেন। এর মধ্যে ২১ খানা প্রকাশ পায়। বাংলা সাহিত্যার স্বার্থক উপন্যাস (প্রথম বিজয় বসন্ত তার উলেখ যোগ্য গ্রহন্থ)। এ ছাড়া কাব্য গ্রহন্থ কোমুদী (১৮৬৬), দ্বদস শিশুর বিবরন (১৮৬৯), পদ্য পুশুরী (১৮৬২) কাঙালহরিনাথকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কাঙালহরিনাথ মথুরানাথ যন্ত্র এবং এম এন প্রেস স্থাপন করলেও পত্রিকা প্রকাশে কখনও স্বচ্ছলতা আসেনি, তিনি লিখেছেন গ্রাম বার্তার রজত জয়ন্তীর প্রাককালে ৭ টাকা ঋনের দায়ে পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। তবে তার বংশধররা এম এন প্রেসটি আকঁড়ে ধরে আছে আজও।
চলতি পর্যটন মৌসুমে আপনিও ঘুরতে যেতে পারেন ইতিহাস ঐতিহ্যের লিলাভূমি কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে। স্বল্প খরচে ১দিনে আপনি কুমারখালীর পাঁচটি দর্শনীয় স্থান ঘুরতে পারবেন। যে কোন ভাবে কুষ্টিয়া শহরে আসুন। যদি মনে করেন কুষ্টিয়া শহরে রাত্রি যাপন করবেন তাহলে একাধিক আবাসিক হোটেল রয়েছে। কুষ্টিয়া শহর থেকে ৪ শত টাকায় একটি অটো ভাঁড়া করুন এবং পাঁচটি দর্শনীয় স্থান ঘুরে আসুন।
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS